মো: মুখলেছুর রহমান
বিশ্ব মহামারী কোভিড ১৯ (করোনা) পৃথিবী থেকে এখনো বিদায় নেয়নি, এমনকি এর প্রতিষেধকও আসেনি। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষ যখন বুঝল করোনার সাথেই বসবাস করতে হবে, তখন বন্দীত্ব জীবন ছেড়ে মানুষ তার গতানুগতিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই পুরনো জীবনের অন্যায় অবিচার সমাজে আবার ফিরে এসেছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ধর্ষণ একটি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তার প্রমাণ বহন করে প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই প্রকাশ্য রাস্তায়, বিভিন্ন যানবাহনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও নারীর যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের প্রকাশিত খবর।
কখনো কখনো গণর্ধষণ নামক পাশবকিতার চরিত্রও কম দেখিনা। আবার এ সমাজে এমন কিছু উন্মাদ রয়েছে, যারা ধর্ষণকে সকলের কাছে দর্শন উপযোগী করার জন্য ভিডিও ধারণ করে ওই মেয়েটিকে সারা জীবনের জন্য সামাজকিভাবে বিচ্ছিন করে দেয়। কিন্তু একটি মেয়ে ধর্ষিতা হলে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সুবিচার পাওয়া উচিত তার কতটুকু পাচ্ছে সেটাই এখন জনমনে প্রশ্ন?
গত বছরের আলোচিত ঘটনা, নুসরাত হত্যার পর প্রত্যাশা ছিল, ধর্ষণ শব্দটি এ সমাজ থেকে মুছে যাবে। সে ধারণা ভুল প্রমানিত হয়েছে। সম্প্রতি সিলেটের এম,সি কলেজে বেড়াতে আসা স্বামীকে আটকে রেখে নববধূকে গণধর্ষণ কিংবা খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে এক প্রতিবন্ধি তরুণীকে দলবেধে ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় স্তম্ভিত করে পুরো সমাজ। এছাড়াও পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কোন্দলের জের ধরেও বহু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় একজন ধর্ষকের অবস্থান এবং একজন ধর্ষিতার অবস্থান যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেখা যায়, আমাদের সমাজ ধর্ষকের প্রতি এখনো যতটা সহানুভূতিশীল ধর্ষিতার প্রতি ততটা নয়। প্রতিদিন দেশের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে কয়জন ধর্ষককে বয়কট করতে পেরেছি? আবার দেখা যায়, অনেক নারী ধর্ষিতা হওয়ার পেছনে নিজের কাধেই দোষ নিয়ে আত্মহত্যার মতো নির্মম মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। অথচ, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালীদের দাপটে অনেক ধর্ষক তখনও বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়ায়।
লেখক মোঃ মুখলেছুর রহমান
একটি ধর্ষণের পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু অপরাধ তো অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত। কারণ যে কোনো কিছুর বদলা হিসেবেও ধর্ষণ শুধু নয়, কোনো অপরাধকেই সমর্থন করা যায় না। আবার সমাজের কিছু মানুষ ধর্ষণের পেছনে নারীদের অবাধে চলাফেরা এবং পোশাককেই দায়ী করে থাকে কিন্তু শিশু ধর্ষণ, শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণ, ভাই কর্তৃক বোন ধর্ষণের ক্ষেত্রে এরূপ ব্যাখ্যা বা দাবীর গ্রহণযোগ্যতা হারায়। সেক্ষেত্রে ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ, যা একটি মেয়ের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতি সাধন করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে যৌন হয়রানি আর ধর্ষণ এখন সমাজের এমন এক ব্যাধি, যা নারীদের জীবনকে নরকময় করে তুলেছে বিকৃত রুচির কিছু মানুষ। এদের কাছে বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু নেই।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ৯ ধারায় ধর্ষণ এবং ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদির সাজা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া অথবা ভয়ভীতি, প্রতারণা বা প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সহিংসতা করলেই তা ধর্ষণ। আর ১৬ বছরের নীচে হলে সম্মতিতে হলেও তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। ধর্ষণের পর যেকোনভাবেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে। এই আইনের তেমন কোনো সমালোচনা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া হাজারটা ধর্ষণের ঘটনায় কতজন ধর্ষককে এই শাস্তির আওতায় আনা গেছে সেটিই এখন আমাদের জিজ্ঞাসা। আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে হাজারো ধর্ষক পার পেয়ে গেলেও ধর্ষিতা মেয়েটির হতাশা মাখা অভিশাপ আর চোখের জল লুকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টাগুলো কিভাবে থামানো যাবে সে বিষয়ে কি কেউ কখনো ভেবে দেখেছেন?
বর্তমানে নারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই বলে আতংকগ্রস্থ হচ্ছে। সুতরাং এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আইনের পাশাপাশি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা জরুরি। তা না হলে নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা শুধুমাত্র আইন দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়।
একই সাথে নারী-পুরুষ উভয়ের শালীনতা বোধটা থাকা খুব জরুরি। শারীরিক চাহিদা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু সে চাহিদা মেটানোর জন্য ধর্ষণের মত বর্বরোচিত কাজ বন্য পশুকে হার মানায়। একই সাথে তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সুষ্ঠ তদন্ত ও সাক্ষীদের যথাযথ সাক্ষ্য প্রদান করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যাতে কোন নির্দোষ ব্যাক্তি দোষী সাব্যস্থ না হয়। এ সূক্ষ্ম বোধগুলো জাগ্রত করতে হলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। দেশের সুবিচার প্রত্যাশী ধর্ষণের শিকার নারীদের পুনর্বাসন সহ সামাজিকভাবে নারীদের প্রতি মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষন করতে হবে। যাতে তারা তাদের পেছনের তিক্ত অভিজ্ঞতা খুব সহজে ভুলে যায়।
মূলত: এ ব্যাধিকে প্রতিরোধ করতে হলে সর্বক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প কোন পথ নেই।
লেখক:
মো: মুখলেছুর রহমান
বি.এস.এস. (অনার্স), এম,এস,এস (অর্থনীতি)
এল.এল.বি (জা: বি:)