আজ ৪ এপ্রিল। ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। করোনা ভাইরাসের কারনে স্মৃতিসৌধে শুধু পুস্পস্তবক অর্পণের মধ্যে উপজেলা প্রশাসন এ দিবসটি পালন করেছেন।
১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত ঘেষা তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে তৎকালিন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৭ জন উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করে দেশকে স্বাধীন করার শপথ নেন।
বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বৈঠক থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন,যুদ্ধের রণকৌশলের অংশ হিসেবে প্রথমে ৪টি সেক্টরে এবং পরে পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। গঠন হয় এসকে ফোর্স ও জেড ফোর্স ।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, পরে মেজর রফিকুল ইসলাম। ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পান প্রথমে খালেদ মোশাররফ পরে মেজর হায়দার। ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর শফিউল্লাহ, পরে মেজর নূরুজ্জামান, ৪ নম্বর সেক্টরে মেজর সি আর দত্ত, ৫ নম্বর সেক্টরে মেজর মীর শওকত আলী, ৬ নম্বর সেক্টরে উইং কমান্ডার বাশার, ৭ নম্বর সেক্টরে মেজর কাজী নূরুজ্জামান, ৮ নম্বর সেক্টরে প্রথমে মেজর ওসমান চৌধুরী পরে মেজর এমএ মনছুর এবং ৯ নম্বর সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর আব্দুল জলিল (অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন এমএ মঞ্জুর)। ১০ নম্বর সেক্টর নৌ-বাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে গঠন করা হয়। ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজন আবু তাহের ও পরে ফ্লাইট লেফটেনেন্ট এম হামিদুল্লাহ।
বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল এম এ রব (বীর উত্তম), সাবেক সেনা প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্র মানিয়ম, এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী, লেফটেনেন্ট সৈয়দ ইব্রাহীম প্রমুখ।
৪ এপ্রিলের বৈঠকের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোটিকে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর এবং পরে ৩ ও ৪ নং নম্বর সেক্টর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ দিনটাকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন। দেশ স্বাধীনের পর তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোর পাশে নির্মান করা হয় বুলিট আকৃতির একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ।
বুলেটের আকৃতিতে তৈরি এই স্মৃতিসৌধের প্রবেশের পথে রয়েছে দুটি ফলক। তাতে অঙ্কিত রয়েছে কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতার পঙ্তিমালা। দক্ষিণ দিকে লাগানো ফলকটি জানান দেয়, এ স্থানটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত। সেখানে স্মৃতিফলকে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা ৩৩ জনের নামের তালিকা।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন বাংলোর পাশে একটি লেক,চারপাশে শুধুই সবুজের বেষ্টনি। নির্জন এই স্থানকেই নিরাপদ মনে করেছিলেন স্বাধীনতাকামী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতেই তারা মহান মুক্তিযুদ্ধ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে এখানে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল বসেছিলেন গোপন বৈঠকে। ঐতিহাসিক ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (এম এ জি ওসমানী)। তিনি ভারতের আগরতলা থেকে এসে ওই বৈঠকে যোগ দেন।
কিন্তু ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রচÐ আক্রমণ শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান থেকে ওই কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মিশে আছে এই তেলিয়াপাড়া চা- বাগানের বাংলোয়। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সম্মুযুদ্ধেরও সাক্ষী বাংলোটি। কিন্তু ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো হিসেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাৎপর্যময় বাংলোটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির দাবি কওে আসছেন মুক্তিযুদ্ধারা। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের পরিকল্পনা আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মানের। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।
শাহজানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন খান বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধেও স্মৃতি বিজড়িত তেলিয়াপাড়া চা বাগানে অবস্থিত স্মৃতিসৌধটিকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন। পরিনত হচেছ আকর্শষনীয় পিকনিক স্পট। বর্তমানে ব্যবস্থাপকের বাংলোটিকে যাদুঘওে রুপান্তরিক করা হলে মুক্তিযুদ্ধেও বিভিন্ন ইতিহাস, দলিলপত্র সংরক্ষিত থাকবে। তিনি বলেন ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদেও উদ্যেগে দিবসটি পালনের জন্য আজ নানা কর্মসূচি ছিল। কিন্ত করোনা ভাইরাসের কারনে এ গুরো স্থগিত করে দেন ইউএনও।
মাধবপুর উপজেলা বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকমল রায় বলেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডা এডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান জীবদ্ধশায় তেলিয়াপাড়ায় বড় পরিসরে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ হতো। তার মৃত্যুও পর আর কেউ উদ্যেগ নেয়নি। তিনি বলেন আমাদের সাংসদও এ ব্যপারে কোন ভূমিকা রাখেনি।
মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমা তুজ জহুরা বলেন সকালে পুস্পস্তবক অর্পণের মধ্যে দিয়ে উপজেলা প্রশাসন এ দিবসটি পালন করেেন। তিনি বলেন কোন প্রোগ্রাম হবে না বলে মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে জানিয়েছেন।