লটকন। একসময়ে একে জংলি ফল বলা হতো। বনে-বাদাড়ে ঝোপ-ঝাড়ে জন্ম নেওয়া গাছে ধরে থাকতো এ ফল। তেমন একটা কদর ছিল না। তবে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ ফলের পুষ্টিগুণ সবার জানা হয়ে গেছে। তাই কদর বেড়েছে বহুগুণে।
সুস্বাদু ও ঔষধিগুণসম্পন্ন হওয়ায় এর চাহিদাও কয়েক গুণ বেড়েছে। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় হতাশ লটকন চাষী জালাল উদ্দীন খান।
লটকন গাছ সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে রোপণের উপযুক্ত সময়। বর্ষার শেষের দিকে মানে ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়। লটকনের গাছ ঝোপের মতো হয়ে থাকে। প্রতিবছর মাঘ-ফালগুনে লটকনগাছে মুকুল আসা শুরু হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে এ ফল পরিপক্ক হয়ে থাকে। এটি চাষে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈব সার দিলে ফলন ভালো হবে। পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের হাত থেকে ফল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়।
কৃষি অফিস জানায়, রোপণের তিন বছরের মধ্যে ফলন আসে এ গাছে। ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০ দিন আগে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বাড়ে।
এ ফল চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিক্রির জন্য কোনো টেনশন করতে হয় না। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান থেকেই কিনে নেন। বাগান কেনার পদ্ধতিও চমৎকার। প্রথমে বাগানের মালিকের কাছ থেকে একদল পাইকার দাম-দর করে বাগান ক্রয় করেন, পরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। প্রকারভেদে পাইকারি মণ প্রতি দাম ওঠে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৮০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে অল্প খরচে সহজেই গড়ে তোলেছে লটকনের বাগান। চারা লাগানোর তিন থেকে চার বছরেই ফল ধরেছে গাছে। স্থানীয়দের কাছে এ ফলটিকে ‘বুগি’ নামে বেশি পরিচিত। সারি সারি গাছে লটকনের থরে থরে ঝুলে থাকার দৃশ্য যে কারোরই চোখ জুড়িয়ে যাবে। বর্ষায় ভিজে থাকা প্রকৃতিতে এ দৃশ্য যেন আরও বেশি ফুটে ওঠেছে। প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করলেও এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে বাজার মূল্য পাচ্ছেনা কৃষক। যাচ্ছেনা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বাজারে।
বলছি, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট সীমান্তবর্তী এলাকা আসামপাড়ার গাজিপুর ইউনিয়নের কেদারটেক গ্রামের লটকন চাষী জালাল উদ্দীন খানের কথা। দুইশ শতক জমির উপর গড়ে তোলা লটকন বাগান। পুষ্টিবিদদের মতে, মানুষের শরীরে একদিনে যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন, মাত্র তিন-চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। ছোট এ ফলটি ভিটামিন বি-টু, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে ভরপুর। যা এই করোনাকালে আমাদের সবার শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কিন্তু উপকার হলেও উপকার পাচ্ছেনা লটকন চাষী জালাল উদ্দীন খান। প্রতিবছর লাভবান হলেও এ বছর লোকসানের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দিশেহারা। বিভিন্ন দেশ থেকে পাইকার না আসায় বিক্রি করতে পারছে না সময় মতো। বাগানের ফল নষ্ট হচ্ছে বাগানেই। পাশাপাশি আম, লেবু ও মাল্টার বাগানও রয়েছে তার। সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লোকসানের কথা বললেন এই কৃষক। তবে তার দাবী স্থানীয় কৃষি বিভাগ সহায়তা করলে ফলন ও ব্যবসায় লাভবান হওয়া যেত।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে যথামসয়ে মাল বিক্রি না হওয়ায় বাগানে কাজ করা শ্রমিকরাও পাচ্ছে না ঠিকমত বেতন। সংসার চালাতেও হিমশিম তাদের।
এদিকে তার বাগান দেখে মুগ্ধ হয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে অনেকেই। দুর-দুরান্ত থেকে আসা বাগান পরিদর্শন করছেন অনেক ব্যক্তি। নিচ্ছেন নানা পরামর্শ।
চুনারুঘাট উপজেলা কৃষি অফিসার মুহাম্মদ জালাল উদ্দীন সরকার বলেন, লটকন চাষ বৃদ্ধিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া লটকনে রোগ বালাইয়ের তেমন সংক্রমণ না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম ফলনও ভালো হয়। বাজারে লটকনের ন্যায্য দাম পাওয়ায় লটকনচাষিও লাভবান হচ্ছেন।
জেলায় প্রথম লটকন চাষে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ অঞ্চলে উৎপাদিত লটকন যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। লটকন চাষ করে আগামীতেও লাভবান হবে এই প্রত্যাশাই আমাদের।